করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতিতে ক্যারিয়ার সচেতনতা ও পদক্ষেপ সমূহ
দুটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করছি।
এক– আমার ছাত্র মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে জানালো তার একটি চাকরি দরকার। সত্তরোর্ধ্ব বাবার চাকুরীর উপর তারা পাঁচ ভাই-বোন এখনও নির্ভরশীল। বাবার চাকুরিদাতা প্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে জানিয়েছে এক-দুই মাসের মধ্যে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
দুই– গত সপ্তাহে একটি মেইল পেলাম। দেড় বছর আগে কোন একটি জবে এপ্লাই করেছিলাম সেই অ্যাপ্লিকেশন সিস্টেম থেকে মেইল এসেছে। দীর্ঘসময়ের গ্যাপ থাকায় অনুধাবন করতে পারছিলাম না এটি কিসের মেইল। পড়ে বুঝলাম রিজেকশন লেটার। আমাকে সিলেক্ট করতে পারেনি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছে। সেইসাথে আমার জব সার্চের জন্য সাফল্য কামনা করেছেন।
মেইলটি সৌজন্যমূলক। প্রায় সব কোম্পানি তা বজায় রাখার চেষ্টা করে। কাউকে ‘না’ করলেও সেটি তারা বেশ সুন্দর করে করে এবং উৎসাহব্যঞ্জক প্রত্যাশা রেখে ইমেইলটি শেষ করে।
ফিরে আসি ২০২০ এ।
আজ থেকে বেশকয়েক বছর আগে ফেসবুকে লিখেছিলাম– আমি চল্লিশ বছর বয়সে এসে যা বুঝতে পেরেছি সেটি যদি ২৫শে বুঝতাম তাহলে ১৫ বছর এগিয়ে থাকতাম।
সেখানে আহ্বান জানিয়েছিলাম তরুণ প্রজন্মকে যারা পঁচিশে বা তার কাছাকাছি বয়সে, তারা যেন এখন থেকেই ক্যারিয়ার এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করে।
ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা মানে কী
আমি যে সামাজিক পরিবেশে বড় হয়েছি সেই প্রেক্ষিত থেকে বলতে পারি বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থী ও যুব সমাজ মোটাদাগে ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা বা পরিকল্পনা করে না।
তারা যেটি করে– খুব অগভীর লেভেলের একটি চিন্তা– কীভাবে একটি জব পাবে।
সেই একটি জব হতে পারে বিসিএস, সেই একটি জব হতে পারে ইঞ্জিনিয়ারিং এর কোন জব। বা ডাক্তারি। ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকতা।
আমার পর্যবেক্ষণ যদি ভুল না হয় এই পরিস্থিতি আগের মতই রয়েছে।
অর্থাৎ ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতনতা আগের মতই একমুখী এবং বলা যায় কপি-পেস্ট টাইপের; সমাজের বা পরিবারের কেউ একজন কিছু একটা করেছে আর সবাই তেমনটি করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে।
বলতে চাইছি– কেউ একজন যেভাবে ভেবেছিলেন সেই একইভাবে এখনও ভাবছি– যে কোন উপায়ে একটি চাকরি পেলেই সবকিছু সার্থক হবে।
যে চর্চাটি আপনাকে অনেকের থেকে এগিয়ে রাখবে
ভবিষ্যত নিয়ে পঁচিশেই ভাবনা শুরু করুন।
কেবল একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগোনো এখনকার সময়ে স্মার্ট আইডিয়া নয়। বরং একাধিক সম্পর্কযুক্ত-বিষয়ে দক্ষতা অর্জন কৌশলগতভাবে লাভজনক।
“কী জব করব” সেটি নয় বরং সেই জবের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন কিনা সেটি নিয়ে ভাবুন।
প্রফেশনাল ক্যারিয়ার যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি বাদে সাধারণ লাইনে যারা পড়াশোনা করছেন তাদের জবের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত।
ইন্টারনেটের বদৌলতে ইনফর্মেশন এখন হাতের মুঠোয়। একটুখানি সময় ব্যয় করলেই এ সম্পর্কিত অনেক লেখা, গবেষণা এবং পরামর্শ জানা যায়। এগুলো পড়া শুরু করুন। তারপর অন্যের মতামতগুলো সামারাইজ করে সেগুলোকে প্রশ্ন করুন এবং নিজের ভাবনা ও যুক্তি দিয়ে সেগুলো সমর্থন বা খন্ডাতে চেষ্টা করুন।
তারপর সেই সারাংশের সাথে নিজের প্রস্ততি মিলিয়ে নিন।
এভাবে চিন্তা করার উপকারিতা কী?
ব্যক্তিগত উদাহরণ দিচ্ছি।
আমেরিকার জব মার্কেটে টিকে থাকতে গেলে সব সময় নিজেকে আপডেটেড রাখতে হয়।
আপডেটেড থাকা শুধুমাত্র টেকনোলজির আপডেট নয় বরং জব মার্কেটের ট্রেন্ড কখন কোন দিকে যাচ্ছে সেটি লক্ষ্য রেখে নিজের স্কিল আপডেটেড রাখতে হয়। সর্বোপরি জব মার্কেট সম্পর্কে আপডেটেড থাকতে হয়।
মার্কেট সম্পর্কে আপডেটেড থাকার জন্য জব মার্কেটে বিচরণ করতে হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন অ্যানালিটিক্যাল জবের বিজ্ঞাপনে কী ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা চাওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে আপডেটেড থাকতে হয়।
এর ফলে চাকরির বাজারে আপনি যা চাওয়া হচ্ছে তার তুলনায় আপনি কোথায় আছেন সেটি বুঝতে পারবেন। আর সে মোতাবেক নিজের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন।
দেড় বছর আগে এপ্লাই করা একটি জব থেকে নেগেটিভ রেসপন্স এসেছে যা উপরে উল্লেখ করেছি। এই দেড় বছরে আমি দুইবার জব পরিবর্তন করেছি। যা ছিল সময়ের প্রয়োজনে এবং নিজের দাম বাড়ানোর তাগিদে। উল্লেখ্য প্রথমবার জব পরিবর্তন করেছি একই অর্গানাইজেশনের ভিতরে। অর্থাৎ প্রমোশন নিয়ে নতুন একটি ডিপার্টমেন্টে চলে গিয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়বার পরিবর্তন করে নতুন শহরে নতুন কোম্পানিতে গিয়েছি।
আমি মনে করি দ্রুত সময়ে এই ছোট দুটি পরিবর্তন আমাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। আর সাফল্যের সাথে অগ্রসর হওয়ার পেছনে জব মার্কেট সম্পর্কে আমার আপটুডেট থাকার বিযয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করি।
তরুণ চাকরিপ্রার্থীরা যেভাবে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে পারে
পূর্বে উল্লেখ করেছি ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবনা শুরু করতে হবে পঁচিশে। মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করার আগেই।
- এই ভাবনাগুলোর ব্যপ্তি ও গভীরতা গতানুগতিক ভাবনা থেকে বেশি হতে হবে
- অর্থাৎ একমুখী চিন্তাভাবনা তথা বিসিএস বা ফাইনান্সিয়াল অর্গানাইজেশনে লোভনীয় চাকরির আশায় বসে না থেকে আর কী কী ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন সেটি ভাবনায় আনতে হবে
- এই বিবেচনাগুলো শুধুমাত্র মস্তিষ্কে রাখলেই হবে না বরং কাগজে লিখতে হবে; ছক কেটে কেটে, ছবি এঁকে দেখতে হবে কোন আইডিয়াগুলো সহজে সম্ভাব্য আর কোনগুলো বেশী চ্যালেঞ্জিং
- অর্থাৎ মাথার ভেতরে যে চিন্তাভাবনা করছেন সেটিকে ট্রান্সলেট করে কাগজে লিখলে তখন আইডিয়ার সীমাবদ্ধতাগুলো বের হয়ে আসবে
- এরপরে সেই সীমাবদ্ধতাগুলো কীভাবে কাটানো যায় সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হবে
- একসাথে একটি মাত্র আইডিয়া নয় বরং একাধিক আইডিয়া নিয়ে খেলা করা যেতে পারে
আইডিয়া নিয়ে খেলা করার পরে যে আইডিয়া গুলো আপনার পছন্দের সাথে যায় এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেই আইডিয়াগুলো বাস্তবায়নের রূপরেখা কাগজে-কলমে তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে কোন কিছুই অসম্ভব নয়।
এভাবে পরিকল্পনা করলে লক্ষ্যে পৌঁছাতে নিজের দক্ষতায় কোথায় গ্যাপ আছে তা বের করা সহজ হবে এবং সে গ্যাপ পূরণের জন্য কাজ করার তাগিত সৃষ্টি হবে।
শেষ কথা
নিজে থেকে ক্যারিয়ার প্রস্ততি নেয়া সহজ নয়। তাই অভিজ্ঞজনের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। তবে তাদেরই পরামর্শ গুরুত্ব দিয়ে নিতে বলব যাদের বর্তমানের হাল হকিকত সম্পর্কে ধারণা আছে।
অভিজ্ঞজনের পরামর্শ আপনার অনেক সময় বাঁচিয়ে দিতে পারে। সেরকম মেন্টর যদি পান সেটি আপনার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে।
ভবিষ্যতে কোন জব পাবেন বা পাবেন না সেই প্রশ্ন না করে বরং প্রশ্ন করুন ভবিষ্যতে যেসব অপরচুনিটি উন্মুক্ত হতে পারে সেগুলোর জন্য আপনি প্রস্তুত কিনা।
যদি প্রস্ততি না থাকে তাহলে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করুন।
এটি সত্যি যে সব ধরনের জবের জন্য প্রস্তুতি নেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সেজন্য আপনি যে বিষয়ে পড়াশুনা করছেন সেই বিষয় ও তার সাথে সম্পর্কযুক্ত চাকুরীগুলোর কথা টার্গেট করে প্রস্তুতি নিতে পারেন।
এ লক্ষে স্কিল ডেভেলপমেন্ট বা দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি কোর্সওয়ার্ক বা ওয়ার্কশপ করার প্রয়োজন হলে সেগুলো আপনার পরিকল্পনার অংশ করে নিন।
শেষ করতে চাই একটি মেসেজ দিয়ে– পাঁচ বছর পরে যে প্রশ্ন নিজেকে করবেন– আহারে কেন পাঁচ বছর আগে এভাবে প্রস্তুত নেইনি– সেই চিত্রটি কল্পনা করে আজ থেকেই নিজেকে তৈরি করা শুরু করুন।
সাবস্ক্রাইব ও শেয়ার করুন
লেখাটি যদি কাজে লেগে থাকে তাহলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আর আমার লেখা সরাসরি ইনবক্সে পেতে নিচে সাবস্ক্রাইব করুন। কোন প্রশ্ন থাকলে মন্তব্যে জানান। অবশ্যই উত্তর দিব।
ধন্যবাদ।
Featured photo by Marten Bjork / Unsplash